techowe.com https://www.techowe.com/2022/09/blog-post_22.html

আরাকান ও রোহিঙ্গা মুসলমান : সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত (পর্ব - ২ )

রোহিঙ্গাদের নির্যাতনের ধারাবাহিক চিত্র

  • রোহিঙ্গারা সর্বপ্রথম জুলুমের শিকার হয় ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে। বার্মার খ্রিস্টান রাজা বোদাপাউপিয়া আরাকান দখল করে রোহিঙ্গা মুসলিমদের নির্দয়ভাবে নির্যাতন করে এবং সে সময় জীবন ও সম্ভ্রম রক্ষার্থে অনেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আসতে বাধ্য হয়। বার্মা ব্রিটিশদের দখলে এলে দীর্ঘ দিন ধরে চট্টগ্রাম অঞ্চলে নির্বাসনে থাকা রোহিঙ্গারা আবার তাদের মাতৃভূমি আরাকানে প্রবেশ করে।

  • বার্মা ব্রিটিশদের অধীনে আসার পর এটিকে ভারতবর্ষের অন্তর্ভুক্ত একটি প্রদেশের মর্যাদা দেয়া হয় এবং সেটি ছিল বৃটিশ-ভারতের বৃহত্তম প্রদেশ। ব্রিটিশ সরকার ১৯৩৭ সালে বার্মাকে ব্রিটিশ-ভারত থেকে পৃথক করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের আলাদা রাজ্যের মর্যাদা দেয়। বার্মাকে ভারতবর্ষ হতে পৃথক করার পর রোহিঙ্গারা স্বাধীনতার জন্যে সংগ্রামে লিপ্ত হয়। এজন্যে ১৯৩৮ সালে আরাকানে বৌদ্ধ-মুসলিম মারাত্মক দাঙ্গা হয় এবং সে দাঙ্গায় বহু মুসলিম হতাহত হয়।

  • দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯-১৯৪৫) চলাকালে ১৯৪২ সালে জপান বার্মা দখল করে। জাপান বার্মা দখল করার পর স্থানীয় মগরা জাপানিদের বার্মা দখল করাকে সমর্থন করে এবং জাপানি সৈন্যদের সহায়তা নিয়ে ব্যাপকহারে মুসলিম রোহিঙ্গাদের হত্যা করে। ইতিহাসে এটি ১৯৪২ সালের গণহত্যা নামে খ্যাত। তখন লক্ষাধিক রোহিঙ্গা মুসলমানকে হত্যা করা হয়। ফলে লাখ লাখ রোহিঙ্গা পার্শ্ববর্তী দেশে আশ্রয় নেয়। ১৯৪৫ সালে ব্রিটিশরা বার্মা ফের দখল করলে রোহিঙ্গারা দলে দলে মাতৃভূমি আরাকানে ফিরে আসে।

  • মূলতঃ ব্রিটিশ শাসনামলে রোহিঙ্গারা মোটামুটি শান্তিতে ছিলো। কিন্তু স্বাধীনতা-উত্তর ১৯৪৭ সালের শাসনতান্ত্রিক নির্বাচনে ইংরেজ সরকার রোহিঙ্গাদের ‘সন্দেহভাজন নাগরিক’ হিসাবে ঘোষণা করায় রোহিঙ্গা মুসলমানদের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়। এটা ছিল ইংরেজদের মারাত্মক ভুল এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র।

  • ১৯৪৮ সালে বার্মা ব্রিটিশ শাসনমুক্ত হয়। তখন উ ন নামক শাসক ক্ষমতা গ্রহণ করে। তিনি আরাকান থেকে মুসলমানদের বিতাড়নের উদ্দেশ্যে ১৯৪৮ সালে মগ সেনাদের নিয়ে Burma Territorial Force গঠন করে নিয়মিত উচ্ছেদ অভিযান শুরু করে। এই অত্যাচারী শাসক পরিকল্পিতভাবে মুসলিম বুদ্ধিজীবী, গ্রামপ্রধান, আলেম-ওলামা, ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষকে হত্যা করে।মুসলমান অধ্যুষিত গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয় আর সেখানে মগদের জন্য বসতি নির্মাণ করা হয়।

  • ১৯৬২ সালের ২ মার্চ উ নকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করে সামরিক শাসক নে উইন। এই পিশাচ ক্ষমতাসীন হলে ফের রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন শুরু হয়, রোহিঙ্গাদের সব সাংবিধানিক অধিকার বাতিল করে দেয়। ১৯৬৪ সালে রোহিঙ্গাদের সব সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন নিষিদ্ধ করে এবং ১৯৬৫ সালের অক্টোবর থেকে Burma Broadcasting Service থেকে প্রচারিত রোহিঙ্গা ভাষার সব অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেয়। নে উইন সরকার রোহিঙ্গাদের উৎখাতের জন্য ব্যাপকহারে গণহত্যা চালাতে থাকে। অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে দলে দলে রোহিঙ্গারা দেশান্তরী হয়।

  • মিয়ানমার সরকার ১৯৭৩ সালে উত্তর আরাকানে Major Aung Than operation ও ১৯৭৪ সালে Sabe operation নামে রোহিঙ্গা উচ্ছেদ অভিযান চালায়। ফলে অসংখ্য রোহিঙ্গা জীবন রক্ষার্থে যুদ্ধবিধ্বস্ত দুর্ভিক্ষপীড়িত বাংলাদেশে এসে নিরাপদ আশ্রয় গ্রহণ করে। সে সময় তৎকালীন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দৃঢ় অবস্থান ও চরমপত্রের কারণে বার্মা সরকার স্বল্প সময়ের মধ্যে বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়।

  • মিয়ানমারের সামরিক জান্তা ১৯৭৮ সালে ‘কিং ড্রাগন অপারেশন’ নামে রোহিঙ্গা উচ্ছেদ অভিযান শুরু করে। এতে দুই লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আগমন ঘটে। রোহিঙ্গাদের ব্যাপকহারে দেশান্তরী হওয়ার বিষয়টি জাতিসঙ্ঘ ও বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রের সহানুভূতি অর্জনে সক্ষম হয় এবং জাতিসঙ্ঘের মধ্যস্থতায় অল্প কিছু রোহিঙ্গা আরাকানে প্রত্যাবাসন করে।

  • মিয়ানমার সরকার ১৯৮২ সালে নতুন নাগরিকত্ব আইন পাস করে, যাতে রোহিঙ্গাদের দেশটির নাগরিক হিসেবে অস্বীকার করে।তখন থেকে মানুষ হিসেবে রোহিঙ্গাদের মানবাধিকারও অচল হয়ে পড়ে। মিয়ানমারে সরকার স্বীকৃত কমপক্ষে ১৩০টি জাতিগোষ্ঠীর বসবাস আছে। কিন্তু প্রজন্মের পর প্রজন্ম মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গারা বসবাস করলেও তাদের স্বীকৃতি দেয়নি রাষ্ট্র। বার শত বছরধরে দেশটিতে বসবাসকারী রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের নাগরিকত্ব হরণের পর থেকেই তাদের নিপীড়ন চরম আকার ধারণ করে।

  • সেই ধারাবাহিকতায় মিয়ানমার সরকার ১৯৮৪, ১৯৮৫ এবং ১৯৯০ সালে রোহিঙ্গা উচ্ছেদে বর্বরতম অভিযান পরিচালনা করে।

  • ১৯৯২ সালে আবার প্রায় আড়াই লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ ঘটে।
  •  ২০১২ সালে সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় কয়েকজন নিহত হওয়ার পর থেকে সহিংসতা ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে।

  • ২০১৬ সালের অক্টোবরে রাখাইনের সহিংসতার ছড়িয়ে পড়ে। সে সময়ে সেনাবাহিনী এবং উগ্র বৌদ্ধরা রোহিঙ্গাদের হত্যা করে এবং নারীদের ধর্ষণ করে। তখন অসংখ্য রোহিঙ্গা বাংলাদেশসহ পার্শ্ববর্তী দেশে আশ্রয় নেয়।
  •  মিয়ানমারের বর্তমান সরকারের আগের সেনাসমর্থিত থিন সেনের সরকারের সময় রোহিঙ্গা শব্দটির ওপর নিষেধাঙ্গা আরোপ করে ইসলাম ধর্মাবলম্বী এ সম্প্রদায়টি বাঙালি নামে অভিহিত হবে মর্মে নির্দেশ জারি করা হয়েছিল। এ ধরনের নির্দেশ একটি জাতি বা সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য ও কৃষ্টির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এবং সম্পূর্ণ মানবাধিকার বিরোধী।
  • জাতিসঙ্ঘের সর্বশেষ রিপোর্টে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে গত ২৫ আগস্ট, ২০১৭ নতুন করে জাতিগত নিধনযজ্ঞ শুরু হওয়ার পর ৭ লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।

নারী নির্যাতন

ধর্ষিতা মুসলিম নারীদের কাছ থেকে জানা যায়, আরাকানে (রাখাইন প্রদেশে)মুসলিম পুরুষরা যখন বাড়ির বাইরে থাকে ঠিক তখন বর্মি সেনারা তাদের বাড়িতে প্রবেশ করে তাদের সন্তানদের সামনেই ধর্ষণ করে।

আরো পড়ুন: আরাকান ও রোহিঙ্গা মুসলমান : সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত (পর্ব - ১ )

কক্সবাজারের লেদা শরণার্থী ক্যাম্পে জাতিসংঘের অভিবাসন সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত একটি ক্লিনিকে কাজ করে নুরাইন তাসনুপা। তিনি জানান, তাদের ক্লিনিকে চিকিৎসা দেয়া বেঁচে যাওয়া অধিকাংশ নারীকেই ধর্ষণের আগে নিষ্ঠুর কায়দায় পেটানো হয়েছে। তিনি বলেন, তিনি নারীদের দেহে আঘাতের চিহৃ এবং তাদের স্তন ও গোপনাঙ্গে কামড়ের দাগ দেখেছেন।

ধর্ষিত এসব নারীদের প্রায় সবাই জানিয়েছে যে, তাদের ধর্ষকরা ছিল ইউনিফর্ম পরিহিত পুরুষ; যাদেরকে মায়ানমারের সামরিক বাহিনীর সদস্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কোন কোন সময় স্থানীয় বৌদ্ধরাও ধর্ষণ এবং লুট-তরাজ করেছিলো।

যৌন সহিংসতাসহ মায়ানমারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তদন্তের জন্য জাতিসংঘের একটি মিশন বাংলাদেশের উদ্বাস্তু ক্যাম্পে কাজ করছে। জাতিসংঘের পর্যবেক্ষকরা জানিয়েছে, তারা মায়ানমারের সাম্প্রতিক জাতিগত সহিংসতা থেকে পালিয়ে আসা অনেক নারীকে দেখেছেন যারা ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন।

বাংলাদেশে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে সর্বশেষ আগমনকারীদের মধ্যে খুব কম সংখ্যক ধর্ষিতাই বেঁচে আছেন বলে মনে হচ্ছে। তবে, ঠিক কতজন নারী ধর্ষিত হয়েছেন তার সঠিক সংখ্যা নির্ণয় করা কঠিন বলে তারা মনে করছেন।

জাতিসংঘের একজন পর্যবেক্ষক জানান, রোহিঙ্গা নারী এখন কঠিন সময় পার করছেন এবং ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট শুরু হওয়া সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনী বার বার রোহিঙ্গা নারী ও কিশোরী মেয়েদের ধর্ষণের কাহিনী শুনছেন।

যৌন সহিংসতা তদন্তে জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিনিধি প্রমিলা প্যাটেন জানান, ‘যৌন সহিংসতাকে ‘সন্ত্রাসের অস্ত্র’ হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে; যাতে টার্গেটকৃত জনসংখ্যা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।’

জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার নিরাপত্তা কর্মকর্তা আইরিন লরিও বলেন, ‘পূর্বে মনে হতো ধর্ষণ একটি হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। মানুষকে জনসম্মুখে উলঙ্গ করে রাখার মাধ্যমে তাদেরকে অপমানিত করা হতো।’ জাতিসংঘের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘কিন্তু এবার তাদেরকে চাপ দেয়া হয়েছে যাতে তারা চলে আসতে বাধ্য হয়।’

নিম্নে নারী নির্যাতনের কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করা হলো:

রোহিঙ্গা শরণার্থী রাজুমা বেগম (২০), তিনি ৩০শে আগস্ট তুলাতলী গ্রামে মিয়ানমার সেনাদের বর্বরতম হত্যাযজ্ঞ থেকে বেঁচে যান। তিনি বলেন, মিয়ানমার সেনারা তুলাতলী গ্রামের রোহিঙ্গাদের নদীর ধারে নিয়ে যায়। সেখানে পুরুষদের নারী ও শিশুদের থেকে আলাদা করে গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা করে।

নদীর তীরে রাজুমা তার ছেলেকে কোলে আকড়ে ধরে রেখেছিলেন। ছেলের বয়স এক বছর চার মাস। চার-পাঁচজন সেনা পাঁচ-সাত জন করে নারীদের ধর্ষণ করতে দফায় দফায় নিয়ে যায়। রাজুমা বলেন, ‘তারা আমাকে ও আরো চার নারীকে একটি বাড়ির মধ্যে নিয়ে যায়। আমার কোল থেকে ছেলেকে ছিনিয়ে নিয়ে মাটিতে ছুড়ে ফেলে। এরপর আমার ছেলের গলা কেটে ফেলে। রাজুমা কাঁদতে কাঁদতে বলে ১০ বছরের এক ছোট ভাই ছিল আমার। তাকেও সেনারা নিয়ে গেছে আর আমি তাকে বাঁচাতে পারিনি।’

রাজুমাকে যে ঘরে রাখা হয়েছিল সেখানে তার সঙ্গে আরো তিন জন বিবাহিতা নারী ছিলেন। আর ছিলেন ৫০ বছরের এক বৃদ্ধা এবং এক তরুণী। সেনারা ওই বৃদ্ধাকে বাদে বাকি সবাইকে ধর্ষণ করে। রাজুমাকে কয়েকজন ধর্ষণ করে। রাজুমার কাছে মনে হয়েছে কমপক্ষে দুই তিন ঘণ্টা ধরে তার ওপর পাশবিক নির্যাতন চলেছে।

ধর্ষণ শেষে সেনারা নারীদের লাঠি দিয়ে মারতে থাকে। তাদের চোখে কয়েকবার টর্চের আলো দিয়ে নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করে মারা গেছে কিনা। পরে তাদের বাড়ির ভেতর তালাবদ্ধ রেখে আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুনের তাপে জ্ঞান ফেরে রাজুমার। বাঁশের দেয়াল ভেঙে বাইরে এসে পালাতে সক্ষম হয় সে। বিবস্ত্র অবস্থায় একটি পাহাড়ে একদিন লুকিয়ে থাকে রাজুমা। পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গাদের রেখে যাওয়া কাপড় পরে সম্ভ্রম ঢাকে বিবস্ত্র রাজুমা। পরে পাহাড়ের অপর দিক দিয়ে বের হয়ে তার গ্রামের আরো তিন নারী ও একজন অনাথের সঙ্গে দেখা হয় তার।সীমান্ত পেরুনোর পর এক বাংলাদেশি তাকে কুতুপালংয়ে পৌঁছাতে সাহায্য করে। সেখানে এক ক্লিনিকে চিকিৎসা সেবা দেয়া হয় তাকে। বাংলাদেশে এসে স্বামী মোহাম্মদ রফিকের (২০) সঙ্গে পুনর্মিলন হয় তার। মোহাম্মদ রফিক তুলাতলীতে হত্যাযজ্ঞ শুরু হওয়ার আগে নদী সাঁতরে পালাতে সক্ষম হন।

রাজুমা বলেন, ‘আমার পরিবারের ৭ সদস্যদের হত্যা করা হয়েছে। আমি, আমার ভাই আর আমার স্বামী বেঁচে আছি। আমি পুরো বিশ্বকে এই ঘটনা জানাতে চাই যেন তারা আরাকানে শান্তি আনতে পারে। সেনারা আমার পরিবারের সাত জনকে মেরে ফেলেছে। আমার দুই বোন রোকেয়া (১৮) বেগম ও রুবিনা (১৫) বেগমকে সেনারা ধরে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করার পর হত্যা করে। আমার মা সুফিয়া খাতুন (৫০), ভাই মুসা আলি (১০), নিকটাত্মীয় খালেদা (২৫)আর তার ছেলে রুজুক আলি (২ বছর,৬ মাস) আর আমার ছেলে মোহাম্মদ সাদিক (১ বছর, চার মাস)-কে সেনারা হত্যা করে।’

রাজুমা বলেন, ‘আমাদের গল্প মানুষের জানাটা গুরুত্বপূর্ণ। রোহিঙ্গা হওয়ার কারণে আমাদের সঙ্গে যা ঘটেছে সেটা।’

(২)

বাঁশ আর ত্রিপলে তৈরি টেকনাফের বালুখালির অস্থায়ী শরণার্থী ক্যাম্পের ভেতর প্লাস্টিকের ম্যাটের ওপর বসে আয়েশা বেগম (২০) নিবিড় স্নেহে কোলে আগলে রেখেছেন এক বছর বয়সী ছেলেকে। আয়েশার বাড়ি ছিল মিয়ানমারের বুথিদাউং শহরের তামি গ্রামে। কয়েকদিন আগে (সেপ্টেম্বর-২০১৭) বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা এই শরণার্থী বলছিলেন, ‘১৩ দিন আগে ধর্ষণের শিকার হয়েছি।’ পাশবিকতার বিভীষিকাময় বর্ণনা দিলেন আয়েশা।

তিনি পরিবারের অপর চার নারী সদস্যের সঙ্গে রাতের খাবার। এমন সময় তাদের গ্রামে হামলা চালায় সেনারা। মিয়ানমার সেনারা তাদের ঘরে ঢুকে নারীদের একটি ঘরের মধ্যে যেতে বাধ্য করে। আয়েশার শিশু সন্তানকে তার কোল থেকে ছিনিয়ে নিয়ে তাকে ফুটবলের মতো লাথি মারে। সেনারা নারীদের বিবস্ত্র করে ফেলে। এক সেনা তার গলায় ছুরি রেখে তাকে ধর্ষণ করা শুরু করে। বারো জন সেনা পালাক্রমে চার নারীর ওপর ধর্ষণযজ্ঞ চালায়। আয়েশার ধারণা কয়েক ঘণ্টা চলেছে ওই বিভীষিকা।

আয়েশা বলেন, ‘আমার মনে হয়েছিল ওরা আমাকে মেরে ফেলবে। ভয় হচ্ছিল, আমার ছেলে মনে হয় মারা গেছে।’ বাংলাদেশে হেঁটে আসতে আট দিন সময় লেগেছে তাদের। আয়েশা বলছিলেন, বাংলাদেশে আসার তিনদিন পর স্বামী আসাদুল্লাহকে খুঁজে পেয়েছেন তিনি।

আয়েশার সঙ্গে ধর্ষণের শিকার হওয়া পরিবারের অপর দুই নারী রাস্তায় মারা যান। আয়েশা বলেন, ‘ওরা এতো দূর্বল ছিল যে মারাই গেল।’আয়েশা বললেন, ‘আমরা বিচার চাই। আমি চাই বিশ্বের সবাই জানুক- আমরা ন্যায়বিচার চাই।’ বাঁশ আর প্লাস্টিক শিটের দেয়ালের ওপার থেকে আরেক নারী চিৎকার করে বললেন, ‘আমরা বিচার চাই।’

আসাদুল্লাহ বললেন, আমার ভেতরে এখন শুধুই ক্ষোভ। আমি মিয়ানমার সেনাদের কিছু করতে পারবো না। আমার স্ত্রীর সঙ্গে যা ঘটেছে তা নিয়ে আমার কোন অভিযোগ নেই। আমি তাকে ভালোবাসি।’

আয়েশা যখন ওই রাতের বর্ণনা দিচ্ছিলেন, তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন তার মা, ভাই, বোন ও স্বামী।

(৩)

মোহসিনা বেগম নামে তামি গ্রামের একজন নারী বলেছেন, তার ১৯ বছর বয়সী বোনকে সেনারা ধরে নিয়ে গিয়েছিল ক্যাম্পে। সে দেখতে সুন্দর ছিল। এলাকার চেয়ারম্যানের মধ্যস্থতায় তাকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হলেও ক্যাম্পে দিনের পর দিন ধর্ষণের কারণে সে খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং বাংলাদেশে আসার পথে মারা যায়। তার লাশ দাফন ছাড়া জঙ্গলে পথে ফেলে চলে আসতে হয়েছে।

মোহসিনা বেগম (২০) নামে আরেক রোহিঙ্গা শরণার্থী তামি গ্রাম থেকে এসেছে। তিনি বলেন, ‘সেনারা আমাদের বাড়িতে ঢুকে আমার ১৯ বছর বয়সী বোনকে নিয়ে যায়। সে অনেক সুন্দরী ছিল। এলাকার চেয়ারম্যানের মধ্যস্থতায় তাকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হলেও ক্যাম্পে দিনের পর দিন ধর্ষণের কারণে সে খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং বাংলাদেশে আসার পথে মারা যায়। তার লাশ দাফন ছাড়া জঙ্গলে পথে ফেলে চলে আসতে হয়েছে।

(৪)

আসমা নামের একজন রোহিঙ্গা নারী বলেন, ১০/১২ জন সৈন্য মিলে আমাকে ধর্ষণ করে, কি যে কষ্ট সহ্য করতে পারছিলাম না, ওদের অত্যাচারে অনেক মেয়ে মরে গেছে। আমাকেও যখন মেরে ফেলতে চাইল, তখন বাচ্চা দু’টোকে দেখিয়ে ওদের পা জড়িয়ে ধরে প্রাণ ভিক্ষা চাইলাম। বললাম, কাউকে বলবো না বার্মায় কী হয়েছে, বাংলাদেশে চলে যাব এখুনি।কাকুতি মিনতি আর ছোট্ট দু’টি বাচ্চা দেখিয়ে ছাড়া পেয়ে ১৫ দিন জঙ্গলে কাটাই। সঙ্গে ১২ বছর বয়সী ছোট ভাই আর দুই সন্তান নিয়ে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই, কিন্তু বাংলাদেশে প্রবেশের চার দিন আগে অসুস্থ হয়ে পথেই মারা গেছে চার বছর বয়সী বড় ছেলেটি। এক সন্তান আর ভাইকে নিয়ে বহু কষ্টে বাংলাদেশে পৌঁছেছি।

হাঁটতে হাঁটতে পা ফুলে গেছে। এদেশে এসে যে সাহায্য পেয়েছি, নিজের দেশে তা পাই নাই। সেখানকার বৌদ্ধরা বলছে, সেদেশ তাদের দেশ, মুসলিমদের দেশ নয়।

(৫)

আরেক রোহিঙ্গা তরুণী রফেকার ভাষ্য- আমার স্বামীর গলা কেটে ফেলেছে সেখানকার বৌদ্ধরা। আর আমার ভাইয়ের স্ত্রীকে ধর্ষণের পর হাত-পা কেটে ফেলে। রফেকা আরো বলেন, মগরা আমাদের বাড়িতে প্রতিনিয়ত হানা দেয়। পুরুষদের ধরে নিয়ে যায় এবং গুলি করে হত্যা করে। মেয়েদের তুলে নিয়ে যায় ক্যাম্পে, তারপর তারা ধর্ষণ করে, হাত-পা কেটে গুলি করে হত্যা করে।

শুধু রাজুমা, আয়শা, মোহসিনা, আসমা, রফেকাই নয়, এরকম লক্ষ লক্ষ নারীর জীবন একেকটা ইতিহাসে পরিনত হয়েছে। হত্যা করা হয়েছে হাজার হাজার নারী শিশু ও পুরুষদের।

(৬)

রোহিঙ্গা নারী শামিলা (৩০) কক্সবাজারের একটি অস্থায়ী শিবিরে বসবাস করছেন। তিনি বলেন, ‘মায়ানমারের তিনজন সৈন্য তার বাড়িতে ঢুকে সন্তানদের সামনে তাকে গণধর্ষণ করে।’ এ কথা বলার সময় তার চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে থাকে।

তিনি বলেন, ‘ধর্ষণের পর তারা যখন চলে যায়, তখন আমি আমার দুই সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছি এবং জীবন বাঁচাতে পালিয়ে আসা অন্যদের সঙ্গে বাংলাদেশের দিকে হাঁটতে শুরু করি।’ ধর্ষণের শিকার হওয়া এই নারী জানান, টানা তিন দিন হেঁটে বাংলাদেশে আসার পর অনেক দিন হয়ে গেলেও এখনো তার রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়নি।

সৈন্যদের হামলার সময় শামিলার স্বামী বাইরে ছিল এবং এখনো পর্যন্ত তিনি তার স্বামীকে খুঁজে পাননি। তিনি জানেন না তার অন্য তিন সন্তান কোথায় আছে। সৈন্যরা যখন আসে তখন ওই তিন সন্তান বাইরে খেলা করছিল।

ধর্ষণ থেকে রেহাই পায়নি রোহিঙ্গা শিশুরাও

নমারের রাখাইন রাজ্যে দেশটির সেনাবাহিনী ও উগ্র বৌদ্ধদের ধর্ষণের হাত থেকে ১০ বছরের কম বয়সী কন্যা শিশুরাও রেহাই পায়নি। আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা মেডিসিন সানস ফ্রন্টিয়ার্স (এমএসএফ) বলছে, বাংলাদেশ সীমান্তের কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরগুলোতে তারা এমন অনেক শিশু পেয়েছেন; যারা রাখাইনে ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এ খবর দিয়েছে দি গার্ডিয়ান।

এমএসএফ বলছে, ধর্ষণের শিকার রোহিঙ্গা শিশুরা শরণার্থী শিবিরগুলোতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। মায়ানমার থেকে পালিয়ে আসা কিশোরী ও নাবালিকা শিশুদের অর্ধেকই যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন।

দাতব্য সংস্থাটি বলছে, কক্সবাজারের কুতুপালংয়ের যৌন এবং প্রজনন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে তারা কয়েক ডজন রোহিঙ্গা শিশুকে যৌন হয়রানির চিকিৎসা দিয়েছেন। যৌন হয়রানির শিকার রোহিঙ্গা নারী, কিশোরী ও তরুণীদের জন্য কক্সবাজারে এই চিকিৎসা কেন্দ্র চালু করা হয়েছে।

সংস্থাটি জোর দিয়ে বলছে, ২৫ আগস্ট রাখাইনে সেনাবাহিনীর অভিযান শুরুর পর যে যৌন সহিংসতা চলেছে এটি তার একটি খণ্ড চিত্র মাত্র। তবে বেঁচে আসা বেশিরভাগই সামাজিক ও অন্যান্য প্রতিবন্ধকতার মুখে ধর্ষণের ঘটনা চেপে যাচ্ছেন এবং চিকিৎসা নেয়া থেকে বিরত আছেন।

‘নাড়ি না কেটেই বাচ্চা নিয়ে দৌড়েছি, কী যে যন্ত্রণা’

হামিদা।বয়স ত্রিশ। ছয় সন্তানের জননী। রাখাইন রাজ্যের মুংডোর কুয়াচং গ্রামে বাস করতো স্বামী ও ছয় সন্তান নিয়ে। তাঁর গর্ভে অপেক্ষা করছে সপ্তম সন্তান।যেকোনো সময় জন্ম নিতে পারে হামিদার সন্তান। কিন্তু হঠাৎ করেই সেদিন (সেপ্টেম্বরের ২ তারিখ) হামলা চালালো সেনাবাহিনী তাদের গ্রামে। বাদ পড়ল না নারী-শিশু-বৃদ্ধ কেউ। অন্তঃসত্ত্বা হামিদা ঘরে শুয়েই শুনতে পাচ্ছিলেন গোলা-গুলির শব্দ আর চিৎকার। তাই অসুস্থ শরীর নিয়ে হামিদা স্বামী ও ছয় সন্তানসহ পাড়ি দিলেন কাছের এক জঙ্গলের দিকে।

হামিদা বলেন, ‘সেদিন হানাদাররা আমাদের গ্রামে হামলা চালাল। তারা আমাদের দিকে রকেট লঞ্চার দিয়ে বোমা ছুড়ছিল। এমনকি পালানো অবস্থায়ও আমাদের গুলি করে মারা হচ্ছিল। পুরো গ্রামটা তারা জ্বালিয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছিল।’

প্রায় দুদিন জঙ্গলে ছিল হামিদার পরিবার। এ সময় হঠাৎ তাঁর প্রসব বেদনা উঠল। পরিস্থিতি চিন্তা করে শিউরে উঠলেন হামিদা। জঙ্গলের মধ্যে চিকিৎসক তো দূরের কথা, সন্তান প্রসবের যন্ত্রণার সময় হাত ধরে রেখে বুকে সাহস জোগানোর মতোও কেউ নেই। এমনকি ছিল না এক টুকরা ছেঁড়া কাপড়ও।

সেই পরিস্থিতির মধ্যেই যন্ত্রণার সঙ্গে তিন ঘণ্টা যুদ্ধের পর সন্তান জন্ম দিলেন হামিদা। এমন সময়ই কাছেই শুনতে পেলেন সেনাবাহিনীর গুলির শব্দ ও হট্টগোল। যেকোনো সময়ই এসে পড়তে পারে তাদের কাছে। তাহলে মৃত্যু নিশ্চিত। এদিকে প্রসবের পর তখনো সন্তানের নাড়ি কাটা হয়নি। সে অবস্থায় আবার দৌড়াতে শুরু করলেন হামিদা। কোলে সদ্যজাত সন্তান এবং সারা শরীরে তীব্র ব্যথা এবং ক্লান্তি। হামিদা বলেন, জীবন বাঁচাতে তার আর কিছুই করার ছিল না।

হামিদা বলেন, ‘কী করতাম সে সময়? তারা আমাদের তাড়া করে বেড়াচ্ছিল। সৈন্যরা ধরতে পারলে আমাকে ও আমার বাচ্চাকে মেরে ফেলত। অনেক যন্ত্রণা হচ্ছিল। অনেক কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু কিছুই করার ছিল না আমার।’ নবজাতককে কোলে নিয়ে কতক্ষণ দৌড়েছিলেন মনে করতে পারেন না হামিদা। তিনি জানান, একপর্যায়ে ক্লান্ত হয়ে পড়লে একটু জিরিয়ে নিতে বসেন তাঁরা। তখন নজরে এলো সন্তানের সঙ্গে তাঁর নাড়ি তখনো যুক্ত রয়েছে। তাঁর স্বামী তখন এক টুকরা বাঁশের ছিলকা কেটে আনেন। বাঁশ ছিলকা দিয়ে কাটা হলো নাড়ি।

এরপর আরো তিনদিন আশ্রয়ের উদ্দেশে পালিয়ে বেড়িয়েছে হামিদার পরিবার। নেই কোনো আশ্রয়, কোনো খাবার। শুধু পানি খেয়েই তাঁরা কাটিয়েছেন এ কয়দিন। এরই মধ্যে নবজাতকের দেওয়া হয়েছে একটি নাম। হোসেন সাহেব। হামিদারা শুনেছে, বাংলাদেশে গেলে সেনাবাহিনীর বন্দুকের গুলি থেকে বাঁচতে পারবেন তাঁরা। তাই সেদিকেই রওনা দিলেন আবার। আরো দুদিনের হাঁটা পথ। দুদিন পর পৌঁছালেন বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের নাফ নদীর তীরে।

হামিদাদের করুণ অবস্থা থেকে তাদের নদী পার করে দিয়ে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন এক বাঙালি মাঝি। নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে যেটুকু পারেন খাবার তুলে দেন ক্ষুধার্ত এই পরিবারটির মুখে। তারপর তাদের নিয়ে যান কক্সবাজারের ঘুমধুম সীমান্তের কাছের একটি শরণার্থী শিবিরে। সীমান্তের কাছের ওই শরণার্থী শিবিরে ৫০ হাজার রোহিঙ্গার বাস। সেখানেই বাঁশ আর ত্রিপল দিলে মাথা গোঁজার ঠাঁই বানালেন হামিদার স্বামী। তারপর, মাঝির দেওয়া কম্বল আর হাড়ি-পাতিল দিয়ে তার অনিশ্চিত জীবন শুরু হয়।

হামিদা বলেন, ‘আমরা এখানে থাকতে চাই না। এভাবে বেঁচে থাকা যায় না। কিন্তু কী করব। প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে এসেছি আমরা।’ কোলে ১৫ দিনের হোসেন সাহেব। অপুষ্টিতে-ক্ষুধায় শিশুটির কান্নার শক্তিও ছিল না। নবজাতকের দিকে তাকিয়ে হামিদা বলেন, ‘তার ক্ষুধা পেয়েছে। কিন্তু আমার বুকে তো দুধ নেই।’

এদিকে ক্ষুধায় হামিদার অন্য শিশুরাও কাঁদছিল। তাদের জন্য খাবার আনতে ত্রাণ আনতে গেছেন হামিদার স্বামী। কিন্তু হামিদা জানে, নয়জনের সংসারে সে খাবার কিছুই না। এতে তাঁর সন্তানদের ক্ষুধা মিটবে না। তাঁরা আবার কাঁদতে থাকবে। কাঁদতে কাঁদতে এক সময় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়বে। এভাবেই চলতে থাকবে জীবন। এ অনিশ্চয়তা কতদিনের আর সবার মতো তা জানেন না হামিদাও।

রোহিঙ্গা গ্রামগুলো পুড়ে ছাই

মিয়ানমারে কর্মরত অধিকাংশ পশ্চিমা দেশসহ ২০ দেশের রাষ্ট্রদূত এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেছেন, তারা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা গ্রামগুলো পরিদর্শনকালে দেখেছেন যে তাদের বাড়ি-ঘর পুড়ে ছাই। বসতবাড়ির বাসিন্দারা অন্য কোথাও পালিয়ে গেছে এবং তারা সেনাবাহিনীর সহিংসতায় ধ্বংসযজ্ঞের দৃশ্য দেখেছেন। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন, ব্রিটেন, জার্মানি, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, চেক প্রজাতন্ত্র, ডেনমার্ক, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, নিউজিল্যান্ড, নরওয়ে, সার্বিয়া, সুইজারল্যান্ড, তুরস্ক, স্পেন, সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের কূটনীতিকগণ এই সফরে অংশ নেন।

মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর সেনাবাহিনীর দমন অভিযান শুরুর পর এক মাসেই ২৮৮টি রোহিঙ্গা গ্রাম পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)।

পলিথিনের ঝুপড়িতে শত কোটি টাকার মালিক

দিল মোহাম্মদ (৬০) মিয়ানমারের মংডু থানার ফকিরাবাজার গ্রামের বিত্তশালী রোহিঙ্গা এবং উক্ত এলাকার চেয়ারম্যান। মুসলিম অধ্যুষিত ওই বাজারে তিনিই ছিলেন সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি। ফকিরাবাজারে তার চারটি স্বর্ণের দোকান ছিল। চাষাবাদের জমি ছিল ৮০ কানি। গরু-মহিষ-ছাগল ছিল অগণিত। ১০-১২ জন কৃষক সারা বছর কাজ করতেন। এলাকার সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন বাড়িতে স্ত্রী-পরিজন নিয়ে ছয়জনসহ ১৮-২০ জনের সংসার সুখেই কাটছিল। মিয়ানমার জান্তারা এক দিনেই আগুন দিয়ে নিঃস্ব করে ফেলেছে। কোটিপতি থেকে মুহূর্তেই হয়ে গেলেন পথের ফকির। এখন উখিয়ার কুতুপালংয়ের ঝুপড়িতে ত্রাণের জন্য কাঙ্গালের মতো চেয়ে থাকতে হচ্ছে। আরাকান রাজ্যের সেনাবাহিনীর অত্যাচার-নির্যাতনের মুখে সব দোকান, বাড়িসহ সহায়সম্পত্তি ফেলে চলে আসেন বাংলাদেশে। কুতুপালং-এ তার গ্রামের লোকজন থাকার জন্য পলিথিনের একটা ঘর নির্মাণ করে দেয়।

দিল মোহাম্মদ জানান, এলাকায় সম্পদশালী ও তৎকালীন হুক্কাট্টা (চেয়ারম্যান) হিসেবে আইন প্রয়োগকারীরাসহ রাখাইনের লোকজন তাকে সমীহ করে চলতেন। প্রশাসনের বিভিন্ন শ্রেণী পেশার লোকজনের সাথে তার মেলামেশা ছিল চোখে পড়ার মতো। তারা আমাকে কথাও দিয়েছিল যে আমি নির্ভয়ে এখানে থাকব, কেউ কিছু করবে না। কিন্তু কথায় আর কাজে মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি।

১৫ দিন আগে একরাতে মিয়ানমার সেনারা আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তোলে। মনে করছিলাম হয়তো তারা কোনো বিষয় নিয়ে আলাপ করতে এসেছে। এমনটি মনে করে আমি বাড়ির লোকজনদের চা-নাশতা তৈরি করতে বলি। এ ফাঁকে রাখাইনের সশস্ত্র যুবকেরা আমার শয়নকক্ষে ঢুকে স্বর্ণালঙ্কার লুট করতে থাকে। একপর্যায়ে আমার বুকে বন্দুক তাক করে বলে, এ মুহূর্তে বাড়ি থেকে বের হয়ে যা, নইলে সবাইকে পুড়ে মরতে হবে। এ সময় আমার হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হওয়ার মতো অবস্থা। প্রাণ বাঁচাতে এক কাপড়ে সবাইকে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সাথে সাথেই মিয়ানমার সেনারা আমার দ্বিতল বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। সেই আগুনের আলোতে আমরা অনেক দূরে চলে এসেছি। কথাগুলো বলতে বলতে তার দু’চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছিল।

তিনি আরো জানান, এর আগে মিয়ানমার সেনা এবং স্থানীয় উগ্র বৌদ্ধরা আমার স্বর্ণের দোকান লুট করে জ্বালিয়ে দেয়ার ঘটনা আমার মোটেই জানা ছিল না। আসার সময় পথিমধ্যে প্রতিবেশীরা আমার ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান লুটপাট ও জ্বালিয়ে দেয়ার বিষয়টি আমাকে অবগত করেন। ওই দোকানগুলোতে প্রায় শত কোটি টাকার স্বর্ণালঙ্কার ছিল বলে তিনি জানান।

তিনি জানান, বাংলাদেশের ওপর আমার অনেক আস্থা আছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকালে এখানকার অনেক বড় বড় লোককে আমার বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছি। খাওয়াদাওয়া করিয়েছি। এমনকি অনেকেই দীর্ঘ সময় রাতযাপনও করেছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম মরহুম শমশের আলম চৌধুরী, মরহুম বিকম আলী আহমদ, মরহুম ওসমান সরওয়ার আলম চৌধুরী এমপি, চট্টগ্রামের লে. কর্নেল হারুন অর রশিদসহ আরো অনেক নাম না জানা লোকজন। তাদের স্ত্রী, পুত্র অথবা স্বজনদের কেউ যদি আমার পরিচয় জানতে পারেন আমি যে কুতুপালং ক্যাম্পের আশ্রয়ে রয়েছি, তাহলে নিশ্চয়ই তারা আমার প্রতি সহানুভূতি জানাতে এগিয়ে আসবেন।

পলিথিনের ছাউনিতে বিত্তশালীরাও

আরিফুল ইসলামের ১০০ একরের চিংড়িঘের। আরও আছে ২০ একরের আবাদি জমি। বাড়িতে সৌরবিদ্যুৎ, ফ্রিজ-টিভি সবই আছে। ছেলেমেয়েরা ঘোরতো দামি গাড়িতে। বর্তমানে আরিফুল বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার তুমব্রু সীমান্তে নো ম্যানস ল্যান্ড-এ ১০ ফুট বাই ১০ ফুটের পলিথিন ছাউনির বাসিন্দা, বেঁচে আছে রিলিফ খেয়ে। তিনি বললেন, ‘প্রথম প্রথম কাঁদতাম, এখন আর কান্না আসে না। চোখের পানি শুকিয়ে গেছে।’

আরিফুল ইসলামের ত্রাণশিবিরটি একটি খালের পাড়ে। পাথরকাটা নামের এই খালটি দুভাগ করেছে দুই দেশকে। এক দিকে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার তুমব্রু সীমান্তের কোনারপাড়া আর অন্য দিকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের তুমব্রু রাইট গ্রাম। পাহাড়-ঘেঁষা কাঁটাতারের বেড়া প্রতিদিন আরও শক্ত করছে মিয়ানমার। বেড়ার ঠিক নিচেই একচিলতে সমভূমি—এর নাম শূন্যরেখা (নো ম্যানস ল্যান্ড)। এটি আন্তর্জাতিক সীমানা, যা কোনো দেশেরই নয়। এই শূন্যরেখার ওপরই বাস করছে আরিফুলেরসহ ১ হাজার ৩৫০ পরিবারের ৬ হাজারের বেশি মানুষ। অন্য সব রোহিঙ্গা থেকে আরিফুল একেবারেই আলাদা। তিনি শিক্ষিত, কথা বলেন শুদ্ধ বাংলায়। আঞ্চলিক ভাষার পাশাপাশি ভালো বাংলা ও ইংরেজি জানেন। এ জন্য রোহিঙ্গারা তাঁকে বাড়তি শ্রদ্ধা করে। তাদের ভাষায়, আরিফুল ‘এলেম’ (জ্ঞানী) ব্যক্তি।

শূন্যরেখায় শিবির হওয়ার কারণে বসতি স্থাপনকারীদের ত্রাণ ও চিকিৎসা নিতে এপারে আসতে হয় খালের হাঁটুজল পেরিয়ে। বললেন, ১০ বছর ধরে তিনি বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যে অনুষ্ঠিত পতাকা বৈঠকে মধ্যস্থতা করেছেন। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বহু কর্মকর্তার সঙ্গে তাঁর দহরম-মহরম ছিল। কিন্তু বিপদের সময় কেউ এগিয়ে আসেনি। নিজের বাড়িতে জ্বলন্ত আগুনের কুণ্ডলী দেখতে দেখতে তিনি সীমান্ত পার হয়েছেন।

আরিফুলের মতো মমতাজ চৌধুরীর জমি আছে ৫০০ একর। ১১টি চিংড়িঘের। বছরে লাখ লাখ টাকা আয়। ধানের জমিও আছে অনেক। আরেকজন দীন মোহাম্মদ ও আখতার চেয়ারম্যান। এঁরা রাখাইন রাজ্যের পাঁচটি জেলার মানুষের কাছে পরিচিত। তাঁরা বললেন, তাঁদের গ্রামে হামলা হয়েছে গত ২৫ আগস্ট রাত একটার দিকে। সেনাবাহিনী মর্টার শেল নিক্ষেপ করে গ্রাম জ্বালিয়ে দিতে শুরু করে। রাতে সবাই জঙ্গলে আশ্রয় নেন। সকাল নয়টা পর্যন্ত সেখানে লুকিয়ে থেকে সীমান্ত পাড়ি দেন। তাঁরা জানান, তুমব্রু রাইট গ্রামে ৪০০ বাড়ি ছিল, এখন একটিও অবশিষ্ট নেই। সবই পোড়া ছাই।

মংডু শহর থেকে ১৪ মাইল দূরের থানা সদর বলীবাজার। সেই বাজারের চারটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিক মো. ইউসুফ। উখিয়ার বালুখালী-১ ক্যাম্পের বাসিন্দা এখন তিনি। বললেন, কোরবানির ঈদের আগের দিন সেনাবাহিনী গ্রামে ও বাজারে হামলা চালায়। সব লোককে ধরে তুলাতলী গ্রামের পাশের নদীতে গুলি করে মারে। পরিবার নিয়ে কোনোমতে পালিয়ে আসেন তিনি। তিনি বলেন, বছরে তাঁর লাখ লাখ টাকা আয়। সেই টাকায় আরও অনেক পরিবার চলে। নিজের এলাকার বড় ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত। কাঁধের গামছা দিয়ে চোখ মুছে রোহিঙ্গা ভাষায় বললেন, ‘এখন ত্রাণের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকি, খুব খারাপ লাগে।’ তাঁর সঙ্গে কথা বলার সময় নবম শ্রেণিপড়ুয়া ছেলেটি দাঁড়িয়ে ছিল।

বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে মংডু পর্যন্ত যে বাস চলাচল করে সেই পরিবহন কোম্পানির মালিক আরিফুল। লোকে তাঁকে আরিফুল সওদাগর হিসেবে চেনে। বালুখালী-১ ক্যাম্পের পাহাড়ের ওপর বেশ ভালো একটি জায়গায় ছাউনি হয়েছে আরিফুল। সেখানে একটি চেয়ারে বসে ছিলেন তিনি শনিবার বিকেলে। কথা বলতে চাইলে বললেন, বাসের পাশাপাশি স্বর্ণ এবং অন্যান্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আছে তাঁর। বছরে ৫-৬ কোটি টাকার ব্যবসা হয়। নিজেও গাড়িতে চড়তেন। বললেন, সেনাবাহিনী ১৩ সেপ্টেম্বর রাতে তাঁদের বাড়িতে হামলা চালিয়েছিল। সবই জ্বালিয়ে দিয়েছে। তাঁর গাড়িটিও বাদ নেই। এখন সব হারিয়ে পথের ভিখারি। আঞ্চলিক ভাষায় যা বললেন তা হলো, "আগে আমি মানুষকে সাহায্য করতাম এখন সাহায্যের জন্যে বসে আছি।"

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর সমন্বিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব শরণার্থীর মধ্যে ৯২ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাইরে অবস্থান করছে। এদের বেশির ভাগই কক্সবাজার শহর, রামু, টেকনাফ এবং উখিয়া উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে অবস্থান করছে। কেউ কেউ চট্টগ্রাম বা অন্য কোথাও চলে গেছে। গত নয় দিনে বিভিন্ন ক্যাম্পে কথা বলে জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের সবাই হতদরিদ্র তা নয়। অবস্থাসম্পন্ন লোকও আছেন। এঁদের কারও আত্মীয়স্বজন বিদেশে থাকেন। কারও আছে দেশ-বিদেশে ব্যবসাও। তাঁরা চেষ্টা করে পূর্বপরিচিত ব্যক্তিদের মাধ্যমে কক্সবাজার বা আশপাশে বাড়ি ভাড়া নিয়ে সেখানে উঠেছেন। আবার অনেকে চলে যাচ্ছেন চট্টগ্রামে। বস্তিতে থাকা তাঁদের পক্ষে দুরূহ। তবে এসব বিত্তশালী নিজের পরিচয় দিতে চান না। পরিচিতজনের কাছেও মুখ লুকান। কথা বলতে চাইলে তাঁদের একটাই জিজ্ঞাসা, ‘ভাই আমরা কবে দেশে যাব?’



অন্যদের সাথে শেয়ার করুন

0 Comments

দয়া করে নীতিমালা মেনে মন্তব্য করুন ??

নটিফিকেশন ও নোটিশ এরিয়া