গর্ভের শিশুর শারীরিক ও মানসিক পরিপূর্ণ বিকাশের পূর্বশর্ত হচ্ছে মায়ের সুস্থতা সুনিশ্চিতকরণ। এ জন্য একজন নারীকে নিজেই যেমন হতে হয় স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন, তেমিন গর্ভবতী মায়েদের প্রতি যত্নশীল হতে হয় পরিবারের সবার।
গর্ভবতী মায়ের পরিচর্যা গর্ভস্থ সন্তান ও মা' উভয়ের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। ২০০৯ সালের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে বছরে প্রায় ২৮০০০ মহিলা গর্ভসঞ্চারজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেন। পাশাপাশি নবজাতক মৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ৮৩ জন।
মা ও শিশুর এ অকাল মৃত্যুর অধিকাংশই প্রতিরোধযোগ্য। কিন্তু এ প্রতিরোধ আমাদের দেশে সম্ভব হয়ে উঠছে না মূলত স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সচেতনতার অভাবে। তাই গর্ভবতী মা-এর যত্ন সম্বন্ধে নিজেকে জানতে হবে ও অনেক জানতে সাহায্য করতে হবেl গর্ভকালীন সময়ে একজন মাকে যে স্বাস্থ্যসেবা দেয়া হয় তাই গর্ভকালীন সেবা । গর্ভধারণের সময় হতে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়া পর্যন্ত সময়কালে মা ও শিশুর যত্নকে গর্ভকালীন যত্ন বা Antinatal Care বলে। এই গর্ভকালীন যত্নের লক্ষ্য হলো মা ও শিশুর সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা এবং গর্ভজনিত কোনো জটিলতা দেখা দিলে তার প্রতিরোধ বা চিকিৎসা করা। এক কথায় মায়ের স্বাস্থ্যের কোনো অবনতি ছাড়াই সমাজকে সুস্থ শিশু উপহার দেওয়া।
পরিকল্পিত গর্ভধারণ
পরিকল্পিতভাবে সন্তান নেওয়া গেলে তা মা ও শিশু দুজনের জন্যই নিরাপদ। যেমন সন্তান ধারণের আগে মায়ের শরীরের কিছু প্রয়োজনীয় পরীক্ষা, যেমন ডায়াবেটিস, থাইরয়েড, হৃদ্রোগ, উচ্চ রক্তচাপ পরীক্ষা করে নিতে হবে। বংশগত কোনো রোগ থাকলে এ বিষয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। যেমন সন্তান ধারণের তিন মাস আগে থেকে নিয়মিত ফলিক অ্যাসিডসহ অন্যান্য ওষুধ খেতে হতে পারে চিকিৎসকের পরামর্শে। বিশেষ করে একটু বেশি বয়সী মায়ের জন্য তো এটি খুবই প্রয়োজন।
গর্ভবতী মায়ের খাদ্য ও পুষ্টি
গর্ভবতী মায়ের জন্য দরকার সুষম খাদ্যতালিকা, এতে করে প্রয়োজনীয় পুষ্টি নিশ্চিত ও খাদ্যঘাটতি দূর করা সম্ভব। এ সময় প্রয়োজন পর্যাপ্ত পরিমাণে মাছ, মাংস, ডিম ও দুধ। এছাড়াও প্রচুর পরিমাণে মওসুমি ফল ও শাক-সবজি খেতে হবে। কেনা শাক-সবজি, ফলমূল বাজার থেকে আনার পর আধাঘণ্টা পর্যন্ত পানিতে ভিজিয়ে খেলে ফরমালিনের ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব। এ সময় প্রচুর পরিমাণে বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে। অতিরিক্ত তেলযুক্ত খাবার না খাওয়াই ভালো।
গর্ভাবস্থায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মায়েদের হিমোগ্লোবিনের ঘাটতি দেখা যায়। ফলে দেখা দেয় রক্তস্বল্পতা। কারণ, এ সময় গর্ভস্থ শিশুর শরীরে লৌহের চাহিদা মেটানোর পর মায়ের রক্তে হিমোগ্লোবিন কমে যেতে দেখা যায়। এই সময়ে গর্ভবতী মায়েদের লৌহসমৃদ্ধ খাবারের পাশাপাশি ক্যালরিসমৃদ্ধ খাবারও বেশি দিতে হবে, কারণ ক্যালরির প্রয়োজন বেশি থাকে। এই ক্যালরি বাড়ানো উচিত প্রোটিন বা আমিষজাতীয় খাবার থেকে। কারণ, প্রোটিনযুক্ত খাবার দিয়েই ভ্রূণের বৃদ্ধি ঘটে থাকে।
প্রাপ্তবয়স্ক প্রতিটি নারীর দৈনিক ২১শ' ৬০ কিলো- ক্যালরি খাদ্যের প্রয়োজন হলেও একজন গর্ভবতীর প্রয়োজন হয় তার চেয়ে ৩৫০ কিলো ক্যালরি খাদ্যের। তা না হলে শিশু অপুষ্টিতে ভুগে ও কম ওজন নিয়ে শিশু জন্মায় যার মৃত্যু আশঙ্কাজনক।এ সময় আমিষ জাতীয় খাবার, উদ্ভিজ্য চর্বি, যা পূরণে ভোজ্য তৈল, সয়াবিন, সরিষা বাদাম। ক্যালসিয়াম এর চাহিদা পূরণ করতে দুধ, স্টিমড ব্রকোলি, পনির, কম চর্বিযুক্ত ইয়োগট, এককাপ ক্যালসিয়ামযুক্ত অরেঞ্জ জুস বা সয় দুধ বা চার আউন্স ক্যান করা শ্যামন মাছ খেয়ে ক্যালসিয়ামের চাহিদা মেটাতে পারেন। আয়রন ও ফলিক এসিড যা কাঁচা কলা, কচুশাক, অন্যান্য ঘন সবুজ ও লাল শাক, মাছ, মাংস ও ডিমে রয়েছে। ভিটামিনের জন্য প্রচুর শাকসবজি, টক, মিষ্টি ফল, জুস খেতে হবে।পানি যা গর্ভস্থ শিশু, পুষ্টির সরবরাহ সঠিক রাখতে এবং শরীর থেকে বর্জ্য পদার্থসমূহ নিষ্কাষণে সহায়ক। তাই গর্ভবতীকে প্রতিদিন ১৫-২০ গ্লাস পানি পান করতে হবে তবে একবারে ২ গ্লাসের বেশি পানি পান করা যাবে না। শর্করা যা অধিক খেলে শরীরে ওজন বেড়ে যায় তাই অাঁশযুক্ত শর্করা যেমন ঢেঁকিছাঁটা চালের ভাত, গমের রুটি ইত্যাদি খাওয়া উচিত।আলু, ও মিষ্টি আলু স্বাস্থ্যসম্মত যা শর্করার চাহিদা পূরণের পাশাপাশি আমিষ লৌহ ও থায়ামিন, ভিটামিন সরবরাহের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। তবে শাকসবজি, ডিম, মাছ বা মাংস ভালো করে সিদ্ধ করে খেতে হবে।লিভার কিংবা লিভার জাত অন্য খাবার কম খেতে হবে। কারণ এগুলোতে উচ্চমাত্রায় ভিটামনি 'এ' থাকায় তা গর্ভস্থ শিশুর ক্ষতি করতে মায়ের অবাঞ্ছিত গর্ভপাত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।কারণ কিছু কিছু খাবার যেমন কাঁচা পেঁপে, আলু, ছোলা, গাজর, বিট, ফুলকপি, ধনেপাতা পুদিনাপাতা, চীনাবাদম, কাজু বাদাম, পেস্তা ইত্যাদিতে এমন কিছু উপাদন আছে যা রান্না না করলে জরায়ুর ভ্রূণের ক্ষতিসাধন করে।ফলে গর্ভপাত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু ভালোভাবে সিদ্ধ করলে এসব ক্ষতিকারক উপাদান নষ্ট হয়ে যাওয়ায় এগুলো কোনো সমস্যা সৃষ্টি করে না। গর্ভাবস্থায় আনারসও ঝুঁকিপূর্ণ।
গর্ভবতী মায়ের পরিধেয়
গর্ভবতী মায়েদের অবশ্যই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, আরামদায়ক, সহজে পরিধানযোগ্য ও ঢিলেঢালা পোশাক পরা উচিত। সঠিক মাপের এবং নরম জুতো পরতে হবে। এক্ষেত্রে অবশ্যই হিল পরিহার করা উচিত।
গর্ভবতী মায়েদের অবশ্যই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, আরামদায়ক, সহজে পরিধানযোগ্য ও ঢিলেঢালা পোশাক পরা উচিত। সঠিক মাপের এবং নরম জুতো পরতে হবে। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই হিল জুতা পরিহার করা উচিত।
গর্ভবতী মায়ের চেকআপ
সম্ভব হলে প্রতি মাসেই একজন অন্তঃসত্ত্বা নারীর চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত। আর কারও যদি জটিলতা থাকে, তাঁকে যখন সমস্যা দেখা দেবে তখনই পরামর্শ নিতে হবে। এমনিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী, একজন অন্তঃসত্ত্বা নারীকে অবশ্যই কমপক্ষে চারবার চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। এই চারবার হচ্ছে যথাক্রমে ১৬, ২৮, ৩২ ও ৩৬ সপ্তাহে।
গর্ভাবস্থায় কমপক্ষে ৪ বার স্বাস্থ্য পরীক্ষা বা চেকআপের জন্য স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেতে হবে মা ও গর্ভস্থ শিশুর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গর্ভবতী মাকে গর্ভকালীন সময়ে কমপক্ষে ৪ বার স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চেকআপের জন্য যাওয়ার সুপারিশ করেছে, এর মাধ্যমে ৬টি সেবা নিশ্চিত করা হয় । তবে মনে রাখা দরকার যে, গর্ভবতী মায়ের অবস্থা ও প্রয়োজন অনুযায়ী ৪ বার এর বেশি চেকআপে যাওয়ার প্রয়োজন হতে পারে ।
বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক নির্ধারিত গর্ভকালীন স্বাস্থ্যসেবা/চেকআপের সময়সূচি
- ১মঃ ৪র্থ মাসের মধ্যে (১৬ সপ্তাহ)
- ২য়ঃ ৬ষ্ঠ মাসে (২৪ সপ্তাহ)
- ৩য়ঃ ৮ম মাসে (৩২ সপ্তাহ)
- ৪র্থঃ ৯ম মাসে (৩৬ সপ্তাহ)
গর্ভকালীন সেবা/চেকআপে যা যা করা হয়
- গর্ভকালীন ইতিহাস নেয়া হয়
- শারীরিক পরীক্ষা করা
- স্রাব পরীক্ষা
- চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা
- প্রতিরোধক বাবস্থাপনা
দীর্ঘ ভ্রমণ?
গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাস এবং শেষ তিন মাসে লম্বা সফরে না যাওয়াই ভালো। উঁচু-নিচু পথ কিংবা ঝাঁকির আশঙ্কা আছে এমন যানবাহনে যাতায়াত করা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। সকাল ও বিকেলে স্বাস্থ্যকর এবং মনোরম পরিবেশে ভ্রমণ করা গর্ভবতী মায়েদের জন্য ভালো, এটি শরীরকে সুস্থ রাখে এবং মনকে প্রফুল্ল রাখে।
গর্ভবতী মায়ের প্রথম তিন মাসের সতর্কতা
প্রথম গর্ভাবস্থার লজ্জা, বমি বমি ভাব, অ্যাসিডিটি, কোষ্ঠকাঠিন্য ইত্যাদি তাকে অস্বস্তিকর করে তোলে। কিন্তু এই সময়েই শিশুর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পূর্ণাঙ্গ আকার ধারণ করে। এ সময় বমি বেশি হলে অ্যান্টিমেটিকস, অ্যান্টাসিড ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করার প্রয়োজনীয় ওষুধের সঙ্গে সবুজ শাকসবজি, ফলমূল ও অন্যান্য পুষ্টিকর খাবার দিতে হবে। এ সময় রক্তের হিমোগ্লোবিন, সুগার ও গ্রুপের মতো ছোট ছোট কিছু পরীক্ষা করাতে হবে। একেবারে প্রয়োজনীয় না হলে আল্ট্রাসনোগ্রাম করার দরকার নেই।
পরবর্তী তিন মাস কোন বিষয়গুলো মনে রাখতে হবে?
যাদের পিরিয়ড অনিয়মিত তাদের তারিখ নিশ্চিত করার জন্য ১২-১৪ সপ্তাহের মধ্যে এবং যাদের বংশগত বা জন্মগত সমস্যা রয়েছে তাদের ২০-২২ সপ্তাহের মধ্যে একটি আল্ট্রাসনোগ্রাম করা উচিত। যেহেতু গর্ভবতী শিশুর শরীর গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান মায়ের কাছ থেকে আসে, তাই মায়ের প্রতিদিনের খাদ্য সুষম হওয়া উচিত; যার মধ্যে থাকতে হবে মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, শাকসবজি, ফলমূল এবং প্রচুর পানি। বিকালে অন্তত দুই ঘণ্টা এবং রাতে অন্তত সাত ঘণ্টা বিশ্রামে থাকতে হবে। আগে টিকা না দিলে গর্ভাবস্থার পাঁচ ও ছয় মাসে দুটি টিকা দিতে হবে। গর্ভবতী শিশুর বৃদ্ধির জন্য আয়রন, ভিটামিন ও ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট খাওয়া ভালো।
শেষ তিন মাস কেন গুরুত্বপূর্ণ?
এই সময়ে গর্ভের শিশু অতি দ্রুত বেড়ে ওঠে। এ সময় অনেক গর্ভবতী মায়ের পায়ে পানি আসে। পেট বড় হওয়ার জন্য সামান্য শ্বাসকষ্ট, অ্যাসিডিটি, স্তন থেকে কিছু তরল পদার্থ নিঃসৃত হতে পারে। গর্ভবতী মায়েদের জন্য এগুলো স্বাভাবিক ব্যাপার। তাকে এই বিষয়গুলো বুঝতে হবে।
এই সময়ে গর্ভবতী মায়ের কিছু জটিলতা দেখা দিতে পারে যেমন পেটের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি বা সংকোচন, হঠাৎ রক্তপাত, উচ্চ জ্বর, উচ্চ রক্তচাপ—এমন পরিস্থিতিতে দ্রুত একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে দেখাতে হবে।
শরীরের বিশেষ যত্ন ও রোগ-প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ
এই সময়ে গর্ভবতী মায়ের প্রতিদিন সাবান দিয়ে ভালভাবে গোসল করা উচিত এবং হাতের নখ এবং পায়ের নখ ছোট রাখা উচিত। গর্ভাবস্থায় মায়ের দাঁত খুব নরম হয়ে যায়, তাই দাঁত ও মাড়ির বিশেষ যত্ন নিতে হবে। চার থেকে আট মাস বয়সের মধ্যে টিটেনাস টিকা দিতে হবে। এ সময় শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা স্বাভাবিকের চেয়ে কম থাকে। তাই ইনফ্লুয়েঞ্জা, হাম, চিকেন পক্স ইত্যাদি সংক্রামক রোগে আক্রান্ত রোগীদের থেকে দূরে থাকুন।
পরিমিত হালকা ধরনের কাজ
একজন মহিলার গর্ভাবস্থায় প্রথম দুই থেকে তিন মাস এবং শেষ তিন মাস অতিরিক্ত পরিশ্রম ছাড়াই হালকাভাবে হাঁটাচলা করা উচিত। ভারী জিনিস বহন বা তুলে যাবে না। পিচ্ছিল স্থানে হাঁটবেন না এবং সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় বিশেষ সতর্ক হতে হবে।
গর্ভবতী মায়েদের টিপস
গর্ভবতী মায়েদের জন্য ৯ টি টিপস যা তাকে অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে-
- ডাক্তারের সাথে সাক্ষাৎ করুন
- ভালো ভাবে খাওয়া-দাওয়া করতে হবে
- সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করুন
- ফুড হাইজিনের বিষয়ে সতর্ক হোন
- নিয়মিত ব্যায়াম করুন
- ক্ষতিকর অভ্যাস ত্যাগ করুন
- ক্যাফেইন গ্রহণ কমান
- বিশ্রাম নিন
- নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ
গর্ভবতী মায়ের মানসিক যত্ন
গর্ভাবস্থায় নারীরা নানা ধরনের দুশ্চিন্তা মধ্যে থাকেন। বিশেষ করে যাঁরা প্রথমবার সন্তানের মা হবেন। গর্ভধারণের নিশ্চিত খবর পাওয়ার পর থেকেই নানা ধরনের অনুভূতির মধ্য দিয়ে যান। চাপ, উদ্বেগ, বিস্মিত বা ভৌতিক অনুভূতি হয় অনেকের। তবে এই অনুভূতিগুলো সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। গর্ভধারণ জীবনের বড় পরিবর্তনের মধ্যে অন্যতম। তাই এই সময়ে মানসিক চাপ একটি স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। কিছু পরিস্থিতিতে চাপ হবু মায়ের জন্য ভালোও হতে পারে। কারণ, এটি তাঁকে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে এবং নতুন প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে সাহায্য করে। তবে অতিরিক্ত মানসিক চাপ অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠতে পারে, যা গর্ভবতী এবং অনাগত শিশু দুজনের জন্যই সমস্যা সৃষ্টি করে।
গর্ভধারণের পরিকল্পনা করার আগে থেকে আপনার মানসিক ও শারীরিক সুস্থতার নিশ্চিত করতে হবে। গর্ভাবস্থায় চাপমুক্ত থাকার জন্য আনন্দে থাকার চেষ্টা করুন। যে পরিস্থিতিগুলো আপনাকে চাপ দেয়, তা লিখে রাখুন। আপনি যখন চাপের মধ্যে থাকেন, তখন আপনার কী হয়, তা লেখার চেষ্টা করুন। গর্ভাবস্থায় কিছু প্রস্তুতিমূলক বই পড়ুন। কারণ, জ্ঞান অর্জন মানসিক চাপকে পরাজিত করার সেরা উপায়। এই সময়ে জাঙ্ক ফুড ও প্রক্রিয়াজাত খাবার এড়িয়ে চলুন। সঠিক খাবার খান এবং আপনার ডায়েটে প্রয়োজনীয় সব পুষ্টি অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করুন। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী জীবন যাপন করুন। প্রতিদিন নিয়ম করে সাঁতারকাটা, হাঁটা বা ব্যায়াম করুন। যোগব্যায়াম, ধ্যান ও শ্বাসের ব্যায়ামগুলো করলে মানসিক স্থিরতা মিলবে। কিছুটা সময় কাটান নিজের মতো করে। নিজের অনুভূতি সম্পর্কে নিজের সঙ্গে খোলামেলা হওয়ার চেষ্টা করুন। নিজের জন্য বরাদ্দকৃত সময়ে এমন কিছু করুন, যা আপনাকে শান্তি দেয়। নিজের আনন্দকে গুরুত্ব দিন। আপনার যেসব বিষয়ে শখ, সেগুলোর চর্চা করুন।
গর্ভাবস্থায় শোয়ার নিয়ম
সন্তানধারণের সম্পূর্ণ সময়টাই একজন নারীর জন্য খুবই স্পর্শকাতর এক সময়। এসময় পেট ধীরে বড় হতে থাকে একারণে ঘুমের সময় অনেকসময় নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হয়। গর্ভাবস্থায় শোয়ার ব্যাপারে কোন সমস্যা হয়ে থাকলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া উচিত। তবে কিছু সাধারণ বিষয় গর্ভাবস্থায় শোয়ার ক্ষেত্রে মাথায় রাখা যেতে পারে।
- চিৎ বা উবু হয়ে শোবেন না
স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, একজন গর্ভবতী মহিলা যখন চিৎ হয়ে শুয়ে থাকেন, তখন তার মেরুদণ্ড এবং কটিদেশীয় হাড়ের উপর প্রচুর চাপ পড়ে, যা শরীরের জন্য ক্ষতিকর।
গর্ভাবস্থায় একজন নারীর শরীরে রিলাক্সিন হরমোন ক্ষরিত হয়, যা বিভিন্ন হাড়ের সংযোগস্থলের টেনডনকে আলগা করে দেয়। ফলে এই সময় তাদের হাড় যথেষ্ট দুর্বল হয়ে পড়ে। পেটের আকার বৃদ্ধি পাওয়ার কারণেই এই দুর্বল হাড়গুলোতে অত্যধিক চাপ পড়ে। এতে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটেই, যন্ত্রণা বাড়লে ঘুমও আসে না সহজে।
- পাশ ফিরে শোওয়ার অভ্যাস করুন
চিকিৎসকরা গর্ভাবস্থায় পরামর্শ দেন পাশ ফিরে শুয়ে থাকতে। একে বলে sleep on side বা সংক্ষেপে SOS। পাশ ফিরে শুয়ে থাকলে আপনার কোমর ও পিঠের হাড়ে কোনোরকম চাপ পড়বে না। হৃৎপিণ্ডের রক্তসঞ্চালনে তাই কোনো সমস্যার সৃষ্টি হয় না। পাশ ফিরে শোওয়ার আরেকটি ভালো দিক হলো নিঃশ্বাসের সমস্যা না হওয়া।
চিকিৎসকরা বলেন, বাম দিকে ফিরে শুয়ে থাকা সব থেকে ভালো এবং এতেই সবচেয়ে আরামে ঘুমানো সম্ভব। কারণ আমাদের লিভার থাকে ডানদিকে, বামদিক ফিরে শুলে লিভারের ওপর চাপ পড়ে না, এতে খাদ্যনালীর সিস্টেম যেমন ঠিকঠাক কাজ করে, তেমনই ঘুমের ক্ষেত্রেও এনে দেয় আরাম।
- এদিক-ওদিক ফেরার ব্যাপারে সাবধান
গর্ভাবস্থায় ঘুমের অসুবিধার কারণে অনেকেই এদিক ওদিক ফিরে নিজের সবচেয়ে কমফোর্ট জোনকে খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু এতে অহেতুক চাপ পড়ে হাড় ও হাড়ের জয়েন্টে। অনেকেই ঘুমের মধ্যে এদিক ওদিক ফিরতে বা শুয়ে থাকার ভঙ্গি বদল করতেই অভ্যস্ত। এমনটা করলে নিজের অজান্তেই রক্তসঞ্চালনে সমস্যা তৈরি হতে পারে, নিঃশ্বাসের সমস্যায় ঘুমেও ব্যাঘাত ঘটতে পারে, এমনকি বাড়তে পারে কোমর ও পিঠের যন্ত্রণা।
তাই চিকিৎসকরা বলেন, যেদিক ফিরেই শুয়ে থাকেন, পিঠের দিকে যেন একটি বালিশ রাখা থাকে। এটি থাকলে সহজে শোওয়ার ভঙ্গি বদলানো অসম্ভব। অনেক নারীরাই বলছেন পাশ ফিরে শুয়ে পা ভাঁজ করে দুপায়ের ফাঁকে একটি বালিশ রাখলে ভালো ঘুম হয়। এ ছাড়া পাশ ফিরে শুয়ে পেটের নিচে একটি বালিশ নিয়ে শুয়ে থাকতেও অনেক আরামবোধ করেন।
গর্ভবতী মায়ের ঘুমানোর নিয়ম
এ সময় দিনের বেলা কমপক্ষে দু-ঘণ্টা ঘুম বা বিশ্রাম এবং রাতে কমপক্ষে আট ঘণ্টা ঘুম আবশ্যক। ঘুমানো বা বিশ্রামের সময় বাঁ-কাত হয়ে শোয়া ভালো।
গর্ভবতী মায়ের বসার নিয়ম
গর্ভাবস্থায় অস্বস্তি লাঘব এবং পিঠের মেরুদণ্ডের ওপর চাপ হ্রাস করার জন্য বসার সঠিক ভঙ্গিমাগুলি অবলম্বন করাটা জরুরি।এই সকল সহজ টিপসগুলি গর্ভাবস্থায় কীভাবে আপনার বসা উচিত তার উপায় আপনাকে দেখাতে পারেঃ
- বসার সময়, আপনার পিঠটি সোজা হওয়া উচিত এবং আপনার কাঁধটি পিছনে টেনে নিচে নামাতে হবে। আর নিতম্বগুলি চেয়ারের পিছনে স্পর্শ হওয়া প্রয়োজন।
- আপনার পায়ের পাতা মেঝের উপর সমানভাবে রাখুন। হাঁটু এবং নিতম্ব 90 ডিগ্রী কোণে সেট করা উচিত। শ্রোণীটিকে সামনের দিকে সামাণ্য ঝুঁকিয়ে সামঞ্জস্য করা উচিত।কানগুলি কাঁধের সাথে সরাসরি সঙ্গতিপূর্ণ হওয়া প্রয়োজন, যা আবার নিতম্বগুলির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হওয়া দরকার।
- বসার জন্য শক্ত, পিঠের দিকটা সোজাভাবে সমর্থনযোগ্য এমন একটা চেয়ার বেছে নিন।অতিরিক্ত সহায়তার জন্য আপনার কোমরের পিছন দিকটায় রাখতে পারেন একটা নরম বালিশ অথবা ছোট একটা তোয়ালেকে রোল করে।
- পায়ের পাতাগুলি একটু উঁচু করে রাখার জন্য একটা ফুটস্টুল বা পা তুলে রাখার ছোট একটা টুল রাখুন।এটি কোমর এবং পিঠের উপর পড়া অতিরিক্ত চাপ কমায়।আর আপনার যদি এভাবে পা তুলে রাখার মত কোনও ছোট টুল না থাকে, সেক্ষেত্রে আপনি বসার জন্য এমন একটি চেয়ার বাছুন যেটি আপনার পক্ষে যথেষ্ট নীচু আর যার উপর বসলে আপনার পায়ের পাতাগুলি সমানভাবে মেঝের ওপর স্পর্শ করবে।
- যদি একটানা অনেকক্ষণ ধরে বসে থাকেন, সেক্ষেত্রে আপনি কয়েকটা সহজ সরল পায়ের পাতার ব্যায়াম করতে পারেন আপনার পায়ে রক্ত সঞ্চালনা বাড়ানো এবং ক্র্যাম্প বা টান লাগা এড়ানোর জন্য।
- বসা অবস্থা থেকে যখনই উঠে দাঁড়াবেন, চেয়ারের একদম প্রান্তের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসুন এবং আপনার পাগুলিকে সোজা করে নিজেকে তুলে ধরুন।
- আপনার কাজের জায়গায় যদি আপনার দীর্ঘক্ষণ বসে থাকর প্রয়োজন হয়, তবে সেক্ষেত্রে নিয়মিত ব্যবধানে মাঝে মধ্যেই উঠে দাঁড়িয়ে কয়েক মিনিটের জন্য হেঁটে নিতে ভুলবেন না।
- কর্মক্ষেত্রে আপনার ডেস্কে বসার সময়, আপনার বসার চেয়ারটিকে এমন এক উচ্চতায় সামঞ্জস্য করুন যাতে আপনার টেবিলের সমান থাকতে পারেন। আপনার ডেস্কটির কাছাকাছি বসুন যাতে আপনি টেবল কিম্বা চেয়ারের ওপর আপনার হাত, কনুইগুলি আরামদায়কভাবে রাখতে পারেন।এটা আপনার কাঁধগুলিকে আরাম দিতে সাহায্য করবে।
- বসার আরেকটা ভাল অবস্থান হতে পারে, চেয়ারের ধার বরাবর বসে পুরোপুরি অবনমিত হওয়া, তারপর নিজেকে আস্তে আস্তে তুলে ধরুন এবং আপনার পিঠের বক্রতাকে যতটা সম্ভব উচ্চ করুন।এভাবে কয়েক সেকেন্ড ধরে রাখুন।এবার অবস্থানটি সামাণ্য শিথীল করুন(মোটামুটি 10 ডিগ্রী মত)।আপনার উভয় নিতম্বের ওপর ওজনটাকে সমানভাবে ভাগ করে নেওয়া নিশ্চিত করুন।
- গর্ভাবস্থার তৃতীয় ত্রৈমাসিকে বসার একটি অবস্থান হিসেবে একটা ব্যালেন্স বা ভারসাম্য বজায়কারী বল ব্যবহার করা উপকারী হতে পারে।তবে আপনার উচ্চতা অনুযায়ী যেটি সঠিক হবে সেরকম দেখেই একটা ক্রয় করা নিশ্চিত করুন।এটি লেবার বা শ্রমের জন্য আপনার শ্রোণীকে প্রস্তুত করতে সাহায্য করতে পারে এবং এমনকি সঠিক অবস্থানে গর্ভস্থ শিশুটিকে থাকাতেও সহায়তা করতে পারে।
- মেঝের ওপর বসার সময়, আপনি মুচির মত উবু হয়ে বসতে পারেন।আপনার হাঁটুগুলিকে মুড়ে এবং গোড়ালিগুলিকে একসাথে সংযুক্ত করে সোজা হয়ে বসুন।
গর্ভবতী মায়ের আমল
সন্তান গর্ভে থাকাকালীন মায়েদের উচিত বেশি বেশি পবিত্র কোরআনুল কারীম তিলাওয়াত করা, নিয়মিত নামায আদায় করা ও ধর্মীয় বই পড়া।
কারণ, এসময়ে মায়েরা যে কাজ গুলো করে থাকেন, সন্তানের আচরণের উপর তার প্রভাব পড়ে। এ সময়ে পরনিন্দা-পরচর্চা করা, ঝগড়া করা, গালা-গালি করা ও অন্যান্য মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকা বাঞ্চনীয়।
সন্তান গর্ভে ধারণের ১ম, ২য় ও ৩য় মাসে গর্ভবতী মহিলা সূরা লোকমান ও সূরা ইনশিক্বাক পড়ুন। ৪র্থ , ৫ম ও ৬ষ্ঠ মাসে সূরা ইউসুফ ও আল ইমরান পড়ুন। আর ৭ম, ৮ম ও ৯ম মাসে সূরা মারইয়াম ও সূরা মুহাম্মাদ পড়ুন।
- সূরা লোকমান পড়লে গর্ভের সন্তান জ্ঞানী, তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও হেকমত ওয়ালা হয়।
- সূরা ইনশিক্বাক পড়লে গর্ভের সন্তান সকল প্রকার ক্ষতি থেকে নিরাপদ থাকে।
- সূরা ইউসুফ পড়লে গর্ভের সন্তানের রুহানী ও জিসমানী উভয় দিক সুন্দর হয়।
- সূরা আল ইমরান পড়লে গর্ভের সন্তান দ্বীনের পথে আহবানকারী হয়।
- সূরা মারইয়াম পড়লে গর্ভের সন্তান পরহেজগার ও আল্লাহ ভীরু হয়।
- সূরা মুহাম্মাদ পড়লে গর্ভের সন্তান সুন্দর চরিত্রের অধিকারী হয়।
গর্ভকালীন ৫ টি বিপদ চিহ্ন
- গর্ভাবস্থায় রক্তস্রাব
- মাথা ব্যাথা ও চোখে ঝাপসা দেখা
- গর্ভাবস্থায়, প্রসবের সময় বা প্রসবের পর খিঁচুনি
- ভীষণ জ্বর
- বিলম্বিত প্রসব
গর্ভকালীন এবং প্রসবকালীন সময়ে এর যে কোনো একটি জটিলতা দেখা দিলে দেরি না করে গর্ভবতী মাকে জরুরি সেবার জন্য মাকে দ্রুত হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যেতে হবে। জেলা হাসপাতাল, মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে নিয়ে যেতে হবে।
প্রসবকালীন সতর্কতা
মাথা ছাড়া অন্য কোনো অঙ্গ প্রথম দেখা দিলে বা বের হয়ে আসতে চাইলে, প্রসবের সময় ১২ ঘণ্টার বেশি হলে, অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ হলে তাড়াতাড়ি তাঁকে হাসপাতালে নিতে হবে।
প্রসবের পরের প্রথম দুই ঘণ্টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ সময় রক্তক্ষরণ, রক্তচাপ পরীক্ষা এবং ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত মাকে বিশ্রাম দিতে হবে। জন্মের পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শিশুকে মায়ের কাছে আনতে হবে এবং মায়ের দুধ খাওয়াতে হবে।
প্রসবের সময় সতর্ক থাকতে হবে বিপদের চিহ্ন সম্পর্কে, যেমন যোনিপথে রক্তপাত, প্রচণ্ড জ্বর, শরীরে খুব বেশি পানি আসা, চোখে ঝাপসা দেখা, অবিরাম বমি, গর্ভকালে বা প্রসবের সময় খিঁচুনি হওয়া। এর একটি চিহ্ন দেখা গেলে এক মুহূর্তও দেরি না করে হাসপাতাল বা চিকিৎসাকেন্দ্রে নিয়ে যেতে হবে। অন্তঃসত্ত্বা মায়ের রক্তের গ্রুপ অনুযায়ী রক্তদাতার ব্যবস্থা করে রাখতে হবে।
বিশেষ সতর্কতা - গর্ভবতী মায়ের যত্ন ও পরামর্শ
অতিরিক্ত আবেগ, মানসিক চাপ, দুশ্চিন্তা, ভয়, রোগ-শোক ইত্যাদি গর্ভবতী মায়ের স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর, তাই এসব এড়িয়ে ভালো চিন্তা করতে হবে। প্রথম তিন মাস ও শেষ তিন মাস স্বামীর সহবাস থেকে বিরত থাকতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ সেবন করা যাবে না। পানিশূন্যতা রোধে স্বাভাবিকের চেয়ে অধিক পরিমাণে পানি পান করতে হবে। সব ধরনের ঝুঁকি এড়াতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া আবশ্যক।
Comments
Post a Comment